সম্প্রতি কলকাতা থেকে প্রকাশিত অনলাইন ম্যাগাজিন ‘মনভাসি’তে প্রকাশিত আমার প্রবন্ধ; https://online.fliphtml5.com/bpdpf/ifml/#p=1
--মুস্তাফা খালীদ পলাশ
বাংলাদেশের সমকালীন চারুকলার কথা বলতে হলে এর সূত্রপাত ঠিক বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের খানিক আগে থেকে শুরু করলে সঠিক চিত্রটি তুলে ধরা হবে না; আরো খানিকটা পেছনে যেয়েই শুরু করা সমীচীন। যদিও এই লেখার মূলপ্রতিপাদ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর-চারুকলার ধারাকে ঘিরে তথাপি উনিশ শতকের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং তার প্রভাবসমূহ সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ না করলে অপূর্ণতা থেকে যাবে। খুব সংক্ষেপে বলা যায় যে দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বাংলার চিত্রকলার নান্দনিক উপাত্ত ছিলো এ অঞ্চলের হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, ইসলাম এবং খৃস্ট ধর্ম থেকে উৎসারিত সংকর সম। তবে বৃটিশ ঔপনিবেশিক কালে এসে পাশ্চাত্য চারুকলার প্রভাবে এই ধারা ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারিয়ে বিলীন হতে থাকে। যদিও ষোড়শ শতাব্দীতেই মুঘল চিত্রকলায় পাশ্চত্য চারুকলার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলে তাদের হাত ধরেই চারুকলার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিকাশ শুরু হয় এবং স্বাভাবিকভাবেই আঞ্চলিক ঐতিহ্য সম্বলিত চারু-প্রথা পাশ্চাত্য ধারার কাছে হার মানতে বাধ্য হয়। আর তা আরো জোড়ালো হয় দেশীয় রাজা-বাহাদুর গোষ্ঠির পৃষ্টপোষকতায়।এই ধারাবাহিকতায় ১৮৫৪ সালে উচ্চবর্গীয় ও বোদ্ধা সমাজের জন্য কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করা হয় প্রথম চারুকলার বিদ্যাপীঠ বেঙ্গল স্কুল অব আর্ট।
বৃটিশরাজের অভিভক্ত বাংলায় ধর্মের মিশ্রতা বর্তমান থাকলেও চারুকলার যে বলয় রচিত হয়েছিলো তা মূলত প্রথা-রীতি-রেওয়াজ বা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আবর্তেই বিরাজমান ছিলো । বৃটিশ শাসন বিরোধী জনরোষের উত্থানের হাত ধরে অবিভক্ত বাংলার চারুকলায় সেই ঐতিহ্যই হয়ে উঠেছিলো বিপ্লবী-হাতিয়ার । পরবর্তিতে ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাজনের পর তদানিন্তন পূর্ববঙ্গ রুপান্তরিত হয় আরেক ঔপনিবেশিক রাজ্যে যা প্রথমে ঠাহর করা না গেলেও অল্প কয়েক বছরেই এ অঞ্চলের মানুষের কাছে তা স্পস্ট হয়ে উঠে। সত্যিকার অর্থে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে বাঙালীদের যে দৃঢ়, মারকুটে ও অনমনীয় অবস্থান ছিলো তার প্রভাব তখনকার চারুকলাকে ধর্মীয় কিংবা আধ্যাত্বিক মনস্তত্বকে উত্তরণ করে এক ভিন্নমাত্রায় নিয়ে যায় । বিভাজিত পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠির উপর শোষণ-নিপীড়ণ সেই ব্রিটিশরাজের মতোই অব্যহত থাকে । ফলশ্রুতিতে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক তথা শিল্প-সাহিত্যে চর্চায় আবার ফিরে আসে সেই বিপ্লবী মানসিকতা । যখন বিভক্ত ভারতবর্ষের বাকী অংশ বর্তমানের ভারত দেশগঠনে নিয়োজিত তখন দুই পাকিস্তানের অন্তর্দন্দ্বের বীজ মাটি থেকে চারা হয়ে সম্পূর্ণ দৃশ্যমান। আবার একদিকে শোষক অন্যদিকে শোষিতের হাহাকার। যদিও সেই হাহাকার ক্ষণিকের ছিলো কারণ বাংলার সন্তানেরা কখনোই মাথা নিচু করার পাত্র নয় ; বৃটিশরাজের কাছেও তারা তা প্রমাণ করেছে । যাই হোক, এটি অনস্বীকার্য যে শিল্প সাহিত্যের গতিবিধি যেমন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে প্রভাবিত করে ঠিক তেমনি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও সেই অঞ্চলের শিল্প সাহিত্যকে ততোটাই প্রভাবিত করে ।
আগেই বলা হয়েছে বাংলায় প্রথম চারু বিদ্যাপীঠ বেঙ্গল স্কুল অব আর্ট প্রতিষ্ঠার কথা এবং তার মাধ্যমে আঞ্চলিক চারুকলার যে সারল্য তাকে অবদমিত করে পাশ্চাত্য ধারার প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে এক নতুন ‘কোম্পানি’ ধারার সৃষ্টি হয় যা কি না পরবর্তিতে প্রত্যাখ্যাত হয়। বলা বাহুল্য যে অবিভক্ত বাংলার জনগোষ্ঠি তথা শিল্পী সমাজের কাছে সে সময় আধ্যাত্মিকতার চেয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতা বেশী প্রাধান্য পেতো বিধায় চারুকলায় সেক্যুলারিজমের বহি:প্রকাশ ছিলো একটি বহুল প্রচলিত ধারা। এই বেঙ্গল স্কুল থেকেই শিল্পীদের মাঝে পূনর্জাগরণের আভাস পরিলক্ষিত হতে থাকে। তাঁরা ভাবতে থাকেন কি করে এই পশ্চিমা আধিক্য কমিয়ে সেই প্রাচীন ঐতিহ্যকে আবার চিত্রকলায় সন্নিবেশিত করা যায় । এই সেক্যুলার পাশ্চাত্য-ভারতীয় মিশ্রণ ধারার প্রবর্তক হিসেবে যিনি প্রভূত যশ ও খ্যাতি অর্জন করেন তিনি আর কেউ নন সে সময়ের প্রগতিশীল ঠাকুর পরিবারের অবনিন্দ্রনাথ ঠাকুর। যামিনী রায় এবং তাঁর সমকালীন চিত্রকলায় অন্যভাবে আবার উদ্ভাসিত হতে থাকে ‘কোম্পানি পেইন্টিং’ বিরোধী বাংলার সেই সারল্য, লোকশিল্প আর সংস্কৃতির জয়গান সাথে সাথে প্রকাশিত হতে থাকে বৃটিশবিরোধী ভারতীয় স্বদেশী-জাতীয়তাবাদ। সে সময়ে চারুকলার পণ্ডিতরা বৃটিশ ঔপনিবেশিক চাল ও ছলচাতুরির বিষয়টি ধরতে পেরেছিলেন এবং এর প্রতিকারের লক্ষ্যে দেশীয় যে ধারা প্রবর্তন করেন তা বেশ কিছু দশক প্রচলিত থাকলেও পরবর্তিতে কেমন যেনো আবার পাশ্চাত্য ধারার কাছে বিলীন হতে থাকে ।
এ কথা অনস্বীকার্য যে দুই বাংলার উৎপত্তি একই গাছের কাণ্ড থেকে, মাঝে তাদের শাখায় বিভক্ত করেছে ধর্মীয় বিশ্বাস; কি ভাষায়, কি শিল্প-সংস্কৃতিতে, কি রীতি রেওয়াজে, সবকিছুতেই তো আজও তাঁরা এক। আর সেকারণেই বুঝি বাঙালীরা সেই কাঁটা তারের বেড়াটিকে মেনে নিলেও মনে নিতে পারে না। যাই হোক, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ৫০ বছরে যখন এর চিত্রকলা নিয়ে কিছু লিখতে হয় তখন তা শিকড় থেকে শুরু করা ছাড়া উপায় থাকে না বিধায় এতোগুলো কথা লিখতেই হলো।
অবিভক্ত বাংলার পূর্বাঞ্চল মুসলমান অধ্যুষিত হওয়া সত্যেও ধর্মীয় গোড়ামীর ঊর্দ্ধে থেকে সব সময়ই তাঁরা সংস্কৃতিকেই প্রনিধানযোগ্য মনে করতেন যার ফলে চারুকলা চর্চা বা শিক্ষার বিষয়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের আগ্রহের কমতি ছিলো না । বেঙ্গল স্কুলে তেমনি বেশ কিছু মুসলিম ছাত্র শিক্ষক ছিলেন যাঁরা ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পর পূর্ববঙ্গে বা তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। এদের মাঝে তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী জয়নুল আবেদীন অন্যতম যিনি পরবর্তীতে শিল্পাচার্য্য উপাধিতে ভূষিত হন। তারঁ সমসাময়িক শিল্পী শফিউদ্দিন আহমেদ এবং শিল্পী কামরুল হাসানও চলে আসেন কোলকাতা ছেড়ে বর্তমান বাংলাদেশে । জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে এই তিন শিল্পীর হাত ধরেই ১৯৪৮ সালে জন্ম হয় ঢাকা আর্ট কলেজের যা কিনা ছিলো দুই পাকিস্তানের প্রথম আর্ট ইন্সটিটিউট ।
নব্য রাস্ট্রের উত্তেজনায় ছেদ পড়তে সময় লাগেনি । ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে শুরু হয় সেই চুড়ান্ত বিভক্তির যাত্রা। ভৌগলিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষার দূরত্ব যে নব্য ঔপনিবেশবাদের আরেক নাম তা ২৪ বছরের সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালী জাতি তা প্রমাণ করেছে ১৯৭১ এ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে । বাংলার মানুষ ধর্মের নামে সংস্কৃতিকে বিসর্জন দেয়নি এবং দেবেও না। চারুকলাও এই প্রভাবের বাইরে ছিলো না । ৫২ পরবর্তীতে সকল সমীকরণ পাল্টে যায়, পাল্টে যায় চারুকলার দর্শন। চিত্রকলায় আসে পরিবর্তন। জয়নুল, শফিউদ্দিন, কামরুলেরা জীবন নির্ভর চিত্রকলার অবতারণা করেন । সাথে যুক্ত হন এস, এম, সুলতান। পরিবেশ, প্রতিবেশ, গ্রাম, মানুষ আর প্রতিবাদ হয়ে উঠে চিত্রকলার মূল উপজীব্য।
সময়ের আবর্তে জয়নুল আবেদীন হয়ে উঠেন শিল্পীচার্য্য, তিনিই তখন চারুকলার নিয়ামক, সাথে তার সহযোদ্ধারা। কালের স্রোতে মধ্য ৫০ দশকে আধুনিক বিমূর্ত ধারার আরেক পথিকৃত মোহাম্মদ কিবরিয়াও চলে আসেন এবং জয়নুল আবেদিন, শফিউদ্দিন আহমেদ ও কামরুল হাসানের সাথে নিজেকে নিবেদিত করেন চারুকলার একনিষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে। ঢাকা আর্ট ইন্সটিটিউট পরিণত হয় চারুকলার এক অগ্নিমণ্ডপে । বলে রাখা ভালো যে ২য় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ১৯৪৩-এর ভয়াবহ দূর্ভিক্ষ কালে জয়নুলের আঁকা রেখা চিত্রগুলো যেমন আলোড়ন তুলেছিলে ঠিক তেমনি ভাবেই সেই ভাবধারা ও প্রকাশের মাধ্যম তাঁকে তার শেষদিন পর্যন্ত জড়িয়ে ছিলো। জয়নুলের জলরঙ আর রেখাচিত্রের প্রতি একাগ্র সাধনা তাঁকে করে তোলে অবিসংবাদি। তিনিই হয়ে উঠেন তাঁর কাজের তুলনা । সমাজ, মানুষ, প্রকৃতি হয়ে উঠে তাঁর ছবির প্রধান উপজীব্য। শিল্পী মর্তুজা বশির, মোহাম্মদ কিবরিয়া, কাইউম চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম, রশিদ চৌধুরী, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, এমদাদ হোসেন সহ বেশ কিছু শিল্পী তৎকালীন ঢাকা আর্ট কলেজ থেকে শিক্ষা নেবার পর তাঁদের মাঝে কেউ কেউ উচ্চতর শিক্ষার জন্য পশ্চাত্যে যান এবং ফিরে এসে এক মিশ্র অ্যাবস্ট্রাক্ট রিয়ালিজম নিয়ে কাজ শুরু করেন ।
১৯৫০-৬০ দশকে যখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলছে চরম নিপীড়ন আর প্রতিবাদী আন্দোলনের ঝড় সেই সময়েই এই বিদ্যাপিঠ থেকেই তৈরী হয় বাংলাদেশের অজস্র চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর। ঠিক এসময়েই বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, লোকগাঁথা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে এ বাংলার চিত্রকলা; সমাজ-পরিবেশ-মানুষ হয়ে উঠে চিত্রে অপ্রাসঙ্গিক। সম্ভবত এর দুটি কারণ; প্রথমত ১৯শতকের শুরুতে পশ্চিমা বিশ্বে আধুনিকতাবাদের যে উত্থান হয় তার পরিণত ঢেউ ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর সারা বিশ্বে ব্যাপৃত হয় বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এবং দ্বিতীয়ত সে সময় এখানকার তরুন শিল্পীরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে উচ্চশিক্ষার গ্রহণ শুরু করে দেশে ফিরে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন । এখান থেকেই এই বাংলায় চিত্রশিল্পের প্রচ্ছন্ন দুটি ধারার সৃষ্টি হয়। প্রথমটি মাটি থেকে উৎসারিত আর পরেরটি বৈশ্বিক আধুনিকতাবাদে প্রভাবিত । মজার ব্যাপার হলো দুটি ধারাকেই সে সময়ের এবং বর্তমান সময়ের দর্শককুল সানন্দে গ্রহণ করেছে।
বলতে দ্বিধা নেই যে আধুনিকতাবাদের প্রভাবে রচিত বিমূর্ত শিল্পকর্ম অপ্রাসঙ্গিকতার কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া সত্বেও লোকজ ধারাকে পেছনে ফেলে চর্চিত হতে থাকে, যা আজও চলছে। এই প্রভাব যে শুধু বাংলার এ অঞ্চলে বিরাজমান তা নয়, পৃথিবীর সকল দেশই এ প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছে এবং হচ্ছে সাথে এসকল চিত্রকর্মের বার্তাহীনতা, মুন্সিয়ানার প্রকাশ বা বিন্যাশের প্রতি জোর দেয়ার বিষয়গুলো সমালোচিতও হচ্ছে। এ সময়ের শিল্পীদের আমরা দ্বিতীয় প্রজন্মের শিল্পী বললেও ভুল হবে না।
পাকিস্তানী সামরিকজান্তার বিস্তৃত শাসনামলে এখানকার শিল্পীরা ফিগারেটিভ কাজ থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকলেও এর ব্যতিক্রম যে ছিলো না তা নয় । ১৯৫২ থেকে শুরু হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীকারের আন্দোলন চূড়ান্ত রুপ নেয় ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে । এই পূর্ণ সময়েই এখানকার শিল্পী সমাজ ছিলো উদ্ধ্যত ও সোচ্চার । বাংলাদেশের আভ্যুদয়ে ‘শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ’ এর ভূমিকা অপরিসীম। তাদেরই সহযোদ্ধার হামিদুর রহমানের হাতেই রচিত হয় শহীদ মিনার যা আজও বাঙালির ও বাংলার প্রতীক। এবার যার নাম না নিলেই নয় তিনি বাংলার অবিসংবাদীত নেতা বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর ৭ মার্চ, ১৯৭১ এর সেই ঐতিহাসিক ভাষনের মাধ্যমে স্বাধিকারের আন্দোলন রুপ নেয় স্বাধীনতার আন্দোলনে। ২৬ মার্চ তাঁর স্বাধীনতা ঘোষনা, ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং অতঃপর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ বিজয়ের মাধ্যমে বিশ্ব মানচিত্রে রচিত হয় এক নতুন রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’।
মুক্ত আকাশ, মুক্ত বাতাস; সবুজের বুকে যে লাল সূর্য উঠলো পরের দিন, তা শুধুই বাংলার, নিরেট বাঙালির। প্রত্যয়, প্রত্যাশার যে বাংলাদেশের সৃস্টি হলো তা ধর্মের ভীতে দাড়িয়ে নয় বরং গণতন্ত্র, সমাজ-সাম্যতা, ধর্মনিরপেক্ষতার এক অভিনব কঠিন ভিত্তিতে ভর করে। এমন একটি বাতাবরণে শৃঙ্খলিত শিল্পী সমাজ যেনো মুক্ত হলো এক অসীম আকাশে । তাঁদের নতুন উপজীব্য হলো মুক্তিযুদ্ধ, বাংলার মাটি বাংলার জল; অপার মমতায় নির্রভার হয়ে তাঁরা তুলিতে আঁকলেন তাদের মনের ভাব । এসময়ে সেই দ্বিতীয় প্রজন্মের সমরজিৎ রায় চৌধুরী , রফিকুন নবী, হাসেম খান, আব্দুস শাকুর শাহ্, শাহাবুদ্দিন আহমেদ ও সমকালীন শিল্পীরা পরিণত হয়ে যুক্ত হলেন অগ্রণী গুরুকুলের সাথে। পাশ্চাত্যের একক আবরণ কাটিয়ে উচ্চশিক্ষায় শিল্পীরা যাত্রা করলো ভারত, জাপান ও চীনের মতো দেশগুলোতে। চারুকলার পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে এলো রাষ্ট্র; চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় প্রতিষ্ঠিত হলো চারুকলা শিক্ষার বিদ্যাপিঠ। একসময়ে চারুকলার কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা আর্ট কলেজ প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইন্সটিটিউটে এবং পরবর্তীতে একটি পূর্ণাঙ্গ অনুষদে রূপান্তরিত হলো ।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের চিত্রকলার বিস্তার দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও সমাদ্রিত হবার পেছনে দ্বিতীয় প্রজন্মের শেষের দিকের এবং তৃতীয় প্রজন্মের গোড়ার দিকের কিছু শিল্পীর অবদান অপরিসীম । এদের মাঝে মনিরুল ইসলাম, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, কালিদাস কর্মকার, শহীদ কবিরের নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁদের কাজের ধারায় স্বকীয়তা বিদ্যমান থাকলেও তাঁরা প্রত্যেকেই আধুনিকতাবাদপন্থি এতে সন্দেহ নেই। এখানে প্রথম প্রজন্মের শিল্পী এস, এম, সুলতানের কথা না বললেই নয় । বহুবছর লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে স্বাধীনতার কয়েক বছর পর এক বিশাল একক প্রদর্শণীর মাঝ দিয়ে নিজেকে পূর্ণ প্রকাশ করেন। তাঁর কাজের ধারায় তৎকালীন চিত্রকলা পরিমণ্ডলে বেশ বড় একটি ধাক্কা লাগে কারণ আগেই বলেছি যে বাংলাদেশের চিত্রকলায় সেই সময় পাশ্চাত্য প্রভাব বিরাজ করছিলো । সুলতানের কাজ হঠাতই আবার সেই মাটির প্রাসঙ্গিকতা কে তুলে আনলো সবার সামনে। বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হলো তার কাজ কন্টেক্সচুয়াল হবার কারণে ।
সময়ের আবর্তে শুধু বাংলাদেশ কালেই পার হয়েছে পাঁচ দশক আর তার সাথে আরো দুদশক। বাংলাদেশের চিত্রকলা পথপরিক্রমায় নানা আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মাঝ দিয়ে আজ পরিণত রূপ ধারণ করেছে । সৃষ্টি করেছে অগণিত শিল্পী। আবুল বারক্ আলভি, হামিদুজ্জামান খান, মাহমুদুল হক, ফরিদা জামান, মোহাম্মদ ইউনুস, রোকেয়া সুলতানা, জামাল আহমেদ, নিসার হুসেন, শেখ আফজাল, শিশির ভট্টাচার্য, মুস্তাফিজুল হক, প্রমূখ স্বাধীনতা উত্তর প্রথম প্রজন্মের শিল্পী যারা আজ অবধি পূর্ণদর্পে কাজ করে যাচ্ছেন । সাথে সাথে এর পরের প্রজন্মের মোহাম্মদ ইকবাল, কনক চাঁপা চাকমা, আনিসুজ্জামান আনিসের মতো শিল্পীদের মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ চিত্রকলার বিশ্বমানচিত্রে একটি পরিচিত নাম ।
আগেই বলা হয়েছে স্বাধীনতা উত্তরকালে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার কথা; বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠা হয় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। চারুকলার পৃষ্ঠপোষকচার পাশাপাশি বিগত চল্লিশ বছর ধরে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি যে ‘এশিয়ান আর্ট বিয়েনাল বাংলাদেশ’ আয়োজন করে আসছে তা বর্তমানে বিশ্বের চলমান প্রাচীনতম বিয়েনাল হিসেবে বিবেচিত ।
চিত্রকলা চর্চার মূল হচ্ছে মুক্তচিন্তা, মুক্ত বাতাবরণ; তাই মুক্ত বাংলাদেশের বাতাবরণ আজ বাঙালির চারুকলা চর্চার চক্রনাভি । পরিশেষে বলতেই হবে যে স্বাধীন বাংলাদেশের চারুকলার ৫০ বছরের হালখাতা আজ এক বিশাল সঞ্চয়ে পরিপূর্ণ।
-ঢাকা ১৪ জুন, ২০২১
Comments